উত্তর বঙ্গের পাহাড় জঙ্গলে -পর্ব ২

আজকাল “offbeat destination” কথাটা খুব ফ্যাশনদুরস্ত একটা ব্যাপার হলেও আমাদের মত ভ্রমনবিলাসী দুধে ভাতে পাতি বাঙালীর কাছে তার অর্থ দাঁড়ায় একটু নিরিবিলি ঘরোয়া পরিবেশ যেখান থেকে কাঞ্চন দার দর্শন পাওয়া যায়। কেতাদুরস্ত হোটেল-রিসোর্ট আমাদের ঠিক ধাতে সয় না। তবু ইন্টারনেটে খুঁজতে হলে তো ছকের মধ্যে থেকেই খুঁজতে হবে। সিলেরিগাঁও, ইচ্ছেগাঁও, কোলাখাম, সিটং, দাওয়াইপানি, কাফের, অহলদাড়া, আরোও কত কি… এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ! খুঁজতে খুঁজতে চারখোল এর Aditya Homestay টা চোখে লেগে গেল বেশ। তার সাথে ফাউ পাওয়া ফুচকার মত কাঞ্চনজঙ্ঘার ১৮০° view এর অমোঘ হাতছানি। বিভিন্ন জায়গায় পড়ে জানলাম যে পরিস্কার দিনে, যে কোনোও Tiger Hill কে হার মানাতে পারে এই দৃশ্য। Website এ ছবি দেখে কেমন যেন নিজেদের “ইচ্ছে”র সেই বাড়িটার মত লাগল – যেন একই বাড়ির ৭টা ঘর! বস্তুত বলে রাখি যে আমাদের চারখোল এর বুকিং Facebook এ পাওয়া সুত্র ধরে করা হয়েছিল ৪ঠা ও ৫ই মে’র জন্য।

শেষ কিছুদিনের নিয়ম ভেঙ্গে আর সব শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে দার্জিলিং মেল NJP ঢুকে গেল কাটায় কাটায় ৮:১৫ য়। আগে থেকে হওয়া কথা অনুযায়ী, বিমল গুরুং ও তার আরো দুই সঙ্গী তাদের গাড়ি করে নিয়ে চলল আমাদের চারখোলের দিকে। তবে, খালি পেটে তো আর ঘোরা যায় না! অগত্যা, Goutam’s এ দাঁড়ানো হল। ১৬ জনের জন্য খাবার order করা কি চাট্টিখানি কথা! এ খাবে momo, ও খাবে toast omlette, সে খাবে egg poach, আবার একটু বেশী পেট ভরার জন্য কেউ বা ছোলা-ভাটুরা…আবার অন্যের momo দেখে, egg poachএর ও momo খেতে ইচ্ছে হয়‌। এদিকে omlette দেখে momoর ও মনে হয়, হলে মন্দ হত না! আর পাহাড়ের সঙ্গে momoর যে এক নাড়ীর টান, তা উপেক্ষা করে কোন বাঙালী! তবে, বলে রাখা ভালো যে প্রচুর বসার ও গাড়ি রাখার জায়গা থাকার ফলে, বড় গ্রুপ এ এলে এই জায়গাটিতে থেমে খাওয়া দাওয়া করা সুবিধে হলেও, খাবারের পরিমান বা স্বাদ তেমন নয়। যাক গে, বিল মিটিয়ে অবশেষে রওনা দিলাম আমরা গন্তব্যের দিকে।

এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত যে Coronation Bridge দেখলে আমাদের nostalgiaর পরিমান প্রায় দার্জিলিং পৌঁছে যাওয়ার সমতুল্য। না হলে তার ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ছবি তুলতে দাঁড়ায়! আমরা অবশ্য সেই সমস্ত আবেগ কে সামলে, ডানদিকে রেখে এগিয়ে চললাম, সাথে সাথে চলল শান্ত অথচ গভীর সবুজ সুন্দরী তিস্তা। Lower Teesta (Rambhi)Dam হয়ে যত উপরে উঠল গাড়ি, প্রতি বাঁকে একটু একটু করে ততটাই দুর হল সমতল আর পাইন, ওক, ফার এর গন্ধে মেশা ঠান্ডা হাওয়া জানান দিতে লাগল পাহাড়ের ছোঁয়া। যত উপরে উঠি, তত মেঘ চলে আসে কাছে…গাড়ির এক জানলা দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে যায় উড়ে। সেই রাস্তার একটি ছোট্ট video দেখতে পাবেন এই link এ। আমরা যারা শহরের ইট, ধুলো, কংক্রিট এ মেশানো হাওয়ায় নিশ্বাস নিই বছরভর, তাদের কাছে এই পাওয়া যে কি দুস্প্রাপ্য, তা উত্তর বঙ্গের দিকে আসা যে কোনোও train এর waiting list দেখলেই বোঝা যায়।

মেঘের রাজ্য দিয়ে সামথার হয়ে আমরা এসে থামলাম, Panbu Dara View Point এ। কিন্তু মেঘলা দিনে পাহাড়ি view point এ চারদিক কেবলই সাদা। যেহেতু দেখা হল না, তাই এই অপূর্ণ ইচ্ছে পূরণ করতে আসতে হবে আবার। দেখতে হবে একদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্যদিকে পাহাড় থেকে সমতলে এঁকেবেঁকে নামতে থাকা তিস্তা, একদিকে ঢেউ এর মত ভাসতে থাকা পাহাড় আর অন্যদিকে চা-বাগান জঙ্গল সমৃদ্ধ সমগ্র ডুয়ার্স অঞ্চল। দৃষ্টি তেমন প্রখর হলে এমনকি Coronation Bridge আর Sevoke Rail Bridge ও দেখতে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মনে আনন্দ থাকলে view point এর সাদা মেঘ দেখেও যে আনন্দে আত্মহারা হওয়া যায়, আমাদের না দেখলে হয়ত কারোর বিশ্বাস ই হবে না!

আর একটা জিনিস ভারি মজার হল। শুনেছি সারমেয়দের ঘ্রাণশক্তি মানুষের চেয়ে বেশী, কিন্তু মানুষ চেনার শক্তি সম্বন্ধে কোনও ধারনা ছিল না। কিন্তু আমাদের দলে অনেকজন ই তাদের ভালোবাসে বলে কিনা জানিনা, আমাদের এই tour এর প্রতি পদক্ষেপে আমরা ও আমাদের বাচ্চারা পাহাড়ি Roadesian দের সঙ্গে বেশ আনন্দ করেছে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।

প্রায় আধঘন্টা মন-প্রাণ ভরে মেঘ মেখে শুরু করলাম আমরা, শেষ ৫ কিলোমিটারের পথ।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s