উত্তর বঙ্গের পাহাড় জঙ্গলে -পর্ব ৩

নেপালি ভাষায় “খোলা” শব্দের অর্থ হল নদী, তাই চারখোল নামটি কোথা থেকে এসেছে তা সন্দেহের অবকাশ রাখে না। এই পাহাড়ি গ্রামের একেবারে চূড়ো থেকে ঝকঝকে দিনে রঙীত নদীর চারটি আলাদা শাখানদী দেখা যায় – অগত্যা, চারখোলা, থেকে চারখোল। লোলেগাঁও থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্হিত এই মনোরম, একরত্তি লেপচা পল্লীটি সমুদ্রতল থেকে ৫৫০০ ফিট উচ্চতায় ফার, ওক, পাইন, রডোডেন্ড্রন ও সাইপ্রাসের জঙ্গলের মধ্যে সযত্নে লালিত। NJP থেকে পৌঁছতে (প্রায় এক ঘন্টা Goutam’s এ আর আধ ঘন্টা Panbu Dara View Point এ কাটিয়ে) আমাদের লাগল ঘন্টা পাঁচেক‌। রাস্তার শেষ মোড়টা ঘুরতেই সামনে দেখতে পেলাম আমাদের সেই “ইচ্ছে” বাড়িটিকে। আমরা পৌঁছনোর আগেই অবশ্য এসে পৌঁছে গিয়েছিল আমাদের সেই “WE time” কাটানো বন্ধু জুটি।

আমাদের এই বাড়িটা চারখোলের উচ্চতম অংশে নয়, কিন্তু সামনে তাকালে একই দৃশ্য দেখা যায় এখান থেকেও। সুন্দর ছিমছাম বাড়িটা তৈরী হয়ে homestay তে পরিনত হয়েছে এক বছর হল। তাই হয়ত সমস্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ। বিশাল ঘরগুলো কাঠের নয় (তাই পাহাড়ে এসে কাঠের বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা হল না) কিন্তু ভারী রুচিশীল, বাহুল্যবর্জিভাবে সাজানো। বাড়ির সামনে সবুজ ঘাসের (কৃত্রিম যদিও) লন থেকে চোখের সামনে পাহাড়ের ঢল ও তাতে বাসা বাঁধা অজস্র মানুষের জীবনের পটচিত্র। পাহাড়ের ঢেউয়ের ওপারে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পর্বতরাজ দেখা না দিলেও তার পরিস্থিস্তি আমাদের অবচেতনে একেবারে জ্বলজ্বলে। কিন্তু পেটে তখন ছুঁচোর ডন, তাই হোমস্টের ছিমছাম অত্যাধুনিক open kitchen cum dining এ গরম ভাত, ডাল, ঢেঁড়সের তরকারি ও ডিমের ডালনার গন্ধের টানের কাছে বাকি সব মোহ মায়া তুচ্ছ। কিন্তু বাচ্চাগুলোকে দেখে মনে হল না খিদে ব্যপারটা জগতে আছে। তাদের তখন খোলা আকাশের নীচে, পাহাড়ের কোলঘেঁষা ছোট্ট এই বসতির ওই সবুজের ওপর ফুটবল নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করা টাই একমাত্র কাম্য। সঙ্গে জুটে গেল গৃহকর্তার ছোট ছেলেটাও। একরকম জোর করেই তাদের খাইয়ে, নিজেরা খেয়ে একটু typical বাঙালী ধাঁচে গড়িয়ে নিতে নিতে সন্ধ্যে নেমে এল। আর সঙ্গে নেমে এল মন খারাপ করা বৃষ্টি। আর সঙ্গে নিয়ে এল আশা – বৃষ্টি হয়ে আকাশ পরিস্কার হলে সকালে যদি তাঁর দেখা পাওয়া যায়!

লনে বসার ব্যবস্থা থাকলেও উপায় নেই তাই নিচের drawing room এই বসল সন্ধ্যার আড্ডা। ইতিমধ্যে এই পাহাড় জঙ্গলের সুবাদে আমাদের যেটা হল সেটাকে পোশাকি ভাষায় বলে digital detox, কারন ইলেক্ট্রিসিটি নিয়ে একরত্তি সমস্যা না হলেও, যেটা হল তা হল network শূন্যতা। রাতে ডাল, তরকারি, মাংস রুটি খেয়ে সকালের ঝকঝকে আলোয় সেই ১০৮° দৃশ্য দেখার আশা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। নাঃ, সকালে তিনি দেখা দিলেন না, কিন্তু দিনটা মেঘলা হলেও হল বেশ ঝকঝকে। সকালের খাবারে নরম তেলবর্জিত পুরী-আলুর তরকারি আর ডিমের ওমলেট খেয়ে বেরিয়ে পড়া গেল চারখোল চরতে।

নিজেদের plan করা tour এর মজা হল কে কোথায় কখন যাবে তার কোনোও বাঁধাধরা নিয়ম থাকে না। তাই একদল চলল চারখোল রিসোর্ট এর পাশ ঘেঁষে ফটক চারখোলের দিকে আর অন্যদল চলল Gamphus Dara view point এর দিকে। আর দুটি বাচ্চা রয়ে গেল বাড়িতেই-সেই ফুটবল নিয়ে। একদল দেখল হর-পার্বতীর বিশাল স্ট্যাচু আর প্রায়-দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট গ্রাম শহর, এঁকেবেকে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী আরেক দল জঙ্গলের ভেতরের সংকীর্ণ পথ বেয়ে পৌঁছল চারখোলের একেবারে শীর্ষে। খানিক পরে অন্য দলটাও এসে পৌঁছল সেখানে। অনভ্যস্ত শরীরের কষ্ট কে একরকম চোখরাঙানি দিয়ে ধমকে নিয়ে যেতে হল বটে, কিন্তু শরীর হ্যাঁচর প্যাচর করলেও তার বিনিময়ে মন যা পেল তা একপ্রকার দুস্প্রাপ্য।

খালি সবুজে চারদিক ঢাকা আর হাজার অচেনা পাখির ডাক, নাই বা দেখা দিক কাঞ্চনজঙ্ঘা…এই পাইন-ফারের জংলি গন্ধে মন প্রাণ ভরে উঠল আবার নতুন করে, সঙ্গে চোখে লেগে থাকল রঙবেরঙের hydrangea, godetia, crown daisy, eastern daisy র এক পরত ও অজস্র নাম না জানা পাখির ডাক। আর একটা জিনিষ ও পাওয়া গেল পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মত – ফোনে signal! পাহাড়ের মাথায় যে এমন একটা ভলিবল কোর্ট (রীতিমত নেট টাঙানো) আর দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দু-দুখানা tower থাকতে পারে তা আমাদের কল্পনাতীত ছিল! দেড় দিন পর সব্বাই বাড়িতে কথা বলে নেওয়া গেল। ফেরার পথে অবশ্য শহুরে রাস্তা আর google maps নির্ভরশীল আমরা দিকভ্রষ্ট হয়ে যে জঙ্গলের পথ ধরেছিলাম তা হয়ত আমাদের পৌঁছে দিত অন্য কোনও পল্লীতে। ভাগ্যের জোরে আমাদের কয়েকজনের বোধ, একটি গাড়ি (Gamphus Dara ওঠার একটা গাড়ির রাস্তা আছে অন্য দিক দিয়ে) ও এক গ্রামবাসী (যার ঘর এই পাহাড়ের এক ধাপে) আমাদের আবার ঠিক পথটা ধরিয়ে দিল। ঘরের ছেলে মেয়েরা আবার ঠিকঠাক ঘরে ফিরে এল।

সন্ধ্যতে জমল আবার আড্ডা আর দুরের বসতি জুড়ে দীপাবলির রাতের মত জ্বলজ্বল করে উঠল আলো। মেঘবিহীন ঝকঝকে আকাশে জ্বলে উঠল হাজার তারার বাতি। সকালে খগেন দা, মুন্না বউদি ও তাদের বাচ্চাদের ও আজকেও না দেখা দেওয়া কাঞ্চনদাকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম আমরা পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এই যাত্রায় চারখোল মনাস্ট্রি দেখাটা বাকি রয়ে গেল, কিন্তু সেটা না হয় পরেরবার দেখে নেব। আপাতত…

“যাবার দিনে এই কথাটি
বলে যেন যাই–
যা দেখেছি যা পেয়েছি
তুলনা তার নাই…”

One thought on “উত্তর বঙ্গের পাহাড় জঙ্গলে -পর্ব ৩

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s