আমাদের সাধারন বাঙালী মনে NJP শুনলেই মাথায় আসে দার্জিলিং বা গ্যাংটক। বহু বছর ধরে তাই হয়ে এসেছে, কিন্তু কালিম্পং যে কি সোনার খনি তা এই প্রথমবার অনুধাবন করলাম। শুধুমাত্র দার্জিলিং এর দোসর হিসাবে নয় – কালিম্পং এর অদ্ভুত এক নিজস্বতা আছে। তন্দ্রাবং পৌঁছনোর আগে একটু কালিম্পং নিয়ে গবেষনা করা যাক।

লেপচা মতে এই নামের উৎস ‘কালেনপুং’ যার অর্থ হল “যে উপগিরিতে জমায়েত হয়”…কার জমায়েত হত এই উপগিরিতে? তিব্বতি ভাষায় ‘কালন’ অর্থে “রাজা এবং/অথবা মন্ত্রীগন” এবং ‘পং’ অর্থে “সম্ভার”, কিছু তিব্বতি পন্ডিতের মতে “জমায়েত” ও হয়… অর্থাৎ কালিম্পং অর্থে “যে পাহাড়ে রাজা বা মন্ত্রীদের জমায়েত হয়”। (এই সফরে এক রাজা আর বাকি সব ই সাধারন প্রজার জমায়েত হতে চলেছে অবশ্য) কিছু বিশেষজ্ঞের মতে এই ‘কালেনপুং’ ক্রমে ‘কালীনবুং’ এবং অবশেষে ‘কালিম্পং’ নামে উপনীত হয়। কালিম্পং এর অন্য একটি অর্থ ও পাওয়া যায় – “যে উপত্যকায় আমরা খেলি” – কথিত আছে কৃষিকর্ম থেকে বিরতি পেলে লেপচা উপজাতিয়রা এখানে খেলা করত। (খেলা এখনোও চলছে, তবে অন্য বিভিন্ন প্রকারের) পাহাড়ি লোকেরা একে ‘কালিবং’ বা ‘কালো শাখা’ বলেও ডাকে।
‘বুং’-‘পুং’-‘বং’-‘পং’ এর চক্করে যে কথাটা ভুললে চলবে না তা হল, ১৯৫৯ সালে চীনের তিব্বত অধিগ্রহনের পর বহু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সেখান থেকে পালিয়ে এসে কালিম্পং এ বহু মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। আসার সময় তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন বহু দুস্প্রাপ্য বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ। ১৯৭৬ এ দালাই লামা স্বয়ং এসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন Zang Dhok Palri Phodang মঠের যেখানে এমন বহু গ্রন্থ সংগ্রহিত আছে। অর্থাৎ কালিম্পং জায়গাটি উত্তর বঙ্গে, শুধু রাজনৈতিক মতেই নয় বৌদ্ধ ধর্ম মতেও এক পীঠস্থান। তাই যত্র তত্র বিভিন্ন রঙের বৌদ্ধ পতাকা উড়তে দেখা যাওয়ার এটি একটি প্রধান কারন। এই সফরে জানলাম যে বাড়িতে কোন আনন্দোৎসব হলে নতুন পতাকা লাগানো হয়, কারন আগের গুলো বাসি হয়ে যায়। আর কোনো বাড়িতে মৃত্যু হলে সেখানে লাগানো হয় সাদা পতাকা।
এবার আসি অন্য এক বং এ – তন্দ্রাবং। সেই বুকিং করার সময় থেকেই এই নামটা বেশ লেগেছিল। বেশ মায়াময়, প্রায় romantic! তন্দ্রাবং এর বুকিং আমরা করেছিলাম Rucksack বলে একটি website থেকে। ছবি দেখে এক ঝলকেই ভালো লেগে গিয়েছিল জায়গাটাকে। যাবার পথটিও ছিল অসাধারন সুন্দর। সেই অসাধারন রাস্তাখানির একঝলক দেখতে এই video টি দেখুন। কিন্তু রোদ ঝলমলে Delo হয়ে যখন আমরা তন্দ্রাবং এর পথে তখন প্রায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল।
তন্দ্রাবং, যাকে স্থানীয় লোকেরা বলে তেন্দ্রাবং, কালিম্পং জেলার মায়রং জঙ্গলের একটি ছোট্ট কুয়াশাচ্ছন্ন লেপচা গ্রাম। স্থানীয় ভাষায় এই নামের অর্থ হল যে স্থানে বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠানের সময় ‘তাংদার’ বা “ড্রামের বাদ্য” বাজানো হয়। কালিম্পং থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হয়েও এমন অস্পর্শিত একটি জায়গা থাকতে পারে তা সেখানে না গেলে বিশ্বাস করা যায়না।

মানুষের অভ্যাস বড় অদ্ভূত জিনিষ আর বিলাসিতার জিনিষগুলোতে তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশী প্রবল হয়ে ওঠে। ঝাঁ-চকচকে Aditya Homestay র পর তাই Flower Valley Homestay র প্রথম দর্শনে মনটা প্রায় ভাঙতেই বসল। গাড়ির রাস্তা থেকে কাঁদামাখা মেঠো সিড়ি বেয়ে দুতলা সমান উঠে homestay র যাকে বলা যায় landing… সেখান থেকে ৩ টি বাড়ি কাছাকাছি – ২টি কাঠের ও একটি কংক্রিটের। কাঠের প্রথমটিতে ২টি ঘর ও দ্বিতীয়টি (এর নাম love cottage) তে একটি ঘর আর তার সঙ্গে লাগোয়া একটি চৌকৌ বারান্দা। অন্য বাড়িটিতে দুটি বেশ বড় ঘর ও সামনে টানা লম্বা বারান্দা। জামাকাপড় ব্যাগ বোচকা সব ভিজে আর তার মধ্যে এখানে overhead electricity বলে বৃষ্টি পড়লেই কারেন্ট বন্ধ। এককথায় বেশ বিরক্তিকর একটা ব্যাপার! যদিও পাহাড়ের বৃষ্টি আর তার থেকে উঠে আসা সোঁদা জংলী গন্ধে তখন চারদিক ম’ম’ করছে। ভালোলাগা-মন্দলাগার দোলাচলে আমরা তখন একেবারে দিশাহারা। দেখুন সেই মুহূর্তের এক ঝলক এই video টি তে।
বলে রাখা ভালো যে এই জায়গাটি Neora Valley National Forest এর এলাকার অন্তরগত, তাই গাছগাছালি বিস্তর, আর বিস্তর পোকামাকড়। তবে যে একরত্তি জীব এই তন্দ্রাবং এ আমাদেরকে প্রায় তন্দ্রাহীন করে রাখার ক্ষমতা নিয়ে উদয় হল, তা হল নিরীহ কেন্নো-যাকে ইংরেজিতে বলে centipede. এদের সাধারনত গাছ এবং বৃষ্টির সঙ্গে নাড়ীর টান তাই বৃষ্টিস্নাত এই জঙ্গলে তাদের অবাধ বিচরন। আর সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে অন্ধকারের মধ্যে তাদের বসতিতে আমাদের এই অনধিকার প্রবেশ আমাদের জন্য রীতিমত ভয়াবহ হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু সময় গড়াতে আর আলো আসার সাথে সাথে যেটা বুঝলাম সেটা হল – এরেই কয় homestay! সন্ধ্যের পড়ন্ত আলোয় চারদিকে যে এক অদ্ভুত সুন্দর রঙ লাগল তা ভাষায় বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার মত তুচ্ছ লেখিকার আয়ত্তের বাইরে।




পাশের সবুজ পাহাড়টা যেন উঠে গেছে উঠোনের কোন থেকেই আর সেখান থেকে ভেসে আসছে কত পোকার ডাক। আমাদের শহুরে অনভ্যস্ত কানে তা প্রায় কোনো বাদ্যযন্ত্রের মতই লাগে…নীচের উপত্যকা থেকে পাহাড় অবধি বিস্তৃত কালিম্পং শহর তখন দেওয়ালির রাতের মত প্রোজ্জ্বল। এই অরন্যের প্রায় মাঝখানে বসে মন গুনগুন করে ওঠে…
এ যে দৃশ্য দেখি অন্য
এ যে বন্য এ অরণ্য
হেথা দিনেতে অন্ধুকার
হেথা নিঝুম চারিধার।
হেথা উর্ধে উচায়ে মাথা দিলো ঘুম
যত আদিম মহাদ্রুম…
এই ছবির মত সুন্দর জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেলার গল্পটা না হয় শেষ ভাগেই বলা যাবে…