গল্পের শেষ অধ্যায় লিখতে বা পড়তে যেমন কষ্ট হয়, যেমন মনে হয় এর পর আর এই ব্যাপারটা নিয়ে আর কোনো ভাবনা হবে না, কল্পনা হবে না – এই শেষ ভাগটি লিখতেও তেমনি কষ্ট হল। তাই হয়ত শুধুমাত্র আর একটু বেশীক্ষণ কাছে রাখার জন্য একটা দিন দেরী হয়ে গেল লিখতে। কষ্ট দুটি – এক হল tour টা সত্যি শেষ আর দুই হল তার কথা রোমন্থন করাও শেষ। কিন্তু তা বলে কি এমনভাবে কিছু অসমাপ্ত রেখে দেওয়া যায়! তাই আবার ফিরে যাই তন্দ্রাবং এ – সেই যেখানে প্রথম দর্শনের যাবতীয় ধারনাকে ধুলিস্মাত করে ভালোবাসা বেড়েছিল তিল করে…
শুরুর খানিক বিশৃঙ্খলার পর যখন মেঘ সরে পাহাড়ি রাতের আকাশে তারা জেগে উঠল কালিম্পং শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, দুরে পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা দিল মেঘের পেছনে অর্ধেক লুকিয়ে থাকা চাঁদ (যেন সেও আমাদের মত দ্বিধায় রয়েছে – ভাবছে বেরোবে কিনা!)…এদিকে আলো আসার সঙ্গে আর বৃষ্টিটা ধরার পরে কেন্নোরাও খানিক উত্তেজনা দমন করে ফিরে গেছে নিজেদের ঘরে – আমাদের সন্ধ্যার আসর বসল খাওয়ার জায়গায়। সেটি একটি দোতলা বাড়ি, যার নিচের তলায় এই বাড়ির রান্নাঘর। আর ওপরের তলাটিতে খাওয়ার ব্যাবস্হা। এই জায়গাটা বড় মজাদার – এতে আছে পাল্লা বা আগলবিহীন ৬ টি জানলা আর ২টি দরজা, যার একটি থেকে পা বাড়ালে সোজা রান্নাঘরের পাশে গিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু এই বন্ধনহীন জানলা দরজা গুলোর মধ্যে কেমন যেন প্রচ্ছন্ন একটা মুক্তির স্বাদ লেগে আছে… যেন যতদূর চোখের বা মনের সীমা তাকে আটকানোর কোনো তাগীদ নেই… হাওয়া, মেঘ, বৃষ্টি সবার ই অবাধ যাতায়াত। বাল্বের আলোয় একটা কি যেন ব্যাপার আছে যা tubelight বা halogenএর আলোতে নেই। সেই আলো, সীমা বৌদির হাতের আলুর পকোড়া আর চিকেন বারবিকিউ, অবাক জলপান আর সঙ্গে গান… প্রেম, বন্ধুত্ব, রাগ, অনুরাগ সবই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল সেই মায়াময় সন্ধ্যায় ওই ছোট্ট অবাধ ঘরটির কাঠের দেওয়ালের ভিতর।



পরদিন সকালের রোদ ঝলমলে আকাশ দেখে কে বলবে কাল সন্ধ্যায় আমাদের এখানের অভ্যর্থনা করতে গিয়ে কেমন অঝোরে চোখের জল ফেলেছিল আকাশ। কিন্তু যা আবারও ভাগ্যে জুটল না তা হল তাঁর দর্শন। কত angle থেকে, কত রকমভাবে যে চেষ্টা চলল… নাথুলার বরফ ঢাকা পাহাড়ের এক কোনা কোনোওমতে দেখে উত্তেজনা বাড়তে জানা গেল আমরা ভুল দিকে তাকিয়ে খুঁজছি।





একেবারে tourist হয়ে কোথাও গেলে যে তাগিদটা থাকে, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেলে সেটা তেমন হয়ত থাকে না, তাই এযাত্রায় একদল গেল পরিক্রমায় আর বাকিরা অলস সময় কাটালো ঘরে বসে।

পথে দ্বিতীয়বার দেখা হল এক বৃদ্ধ পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে। বৃদ্ধ তিনি অবশ্য স্রেফ নামে… রোজ এক ই খাঁড়াই পথ বেয়ে তিনি সংগ্রহ করে আনেন প্রয়োজনের সামগ্রী, ঘরের মানুষের জন্য। ছেলে হয়ত তার বাইরে থাকে কাজের সুবাদে, বা হয়ত… কিন্তু তিনি অবিচল। কেন জানি তাকে দেখে মনে পড়ে যায়…
‘এই বুড়ো গাছের পাতায়
সবুজ কিন্তু আজো মাতায়, সুঠাম ডালে…’
সকালের আলোয় আবার নতুন করে চেনা গেল ছোট্ট সুন্দর ছিমছাম হোমস্টেটিকে। সামনেই একটা গাছ ঘিরে উঁচু করে মাচা করা যেখান থেকে চারদিকের বেশ ৩৬০° নজরে এসে যায়। চারদিকে কত শত রকমের গাছ, তাদের কেউ বা ফুল দেয়, কেউ দেয় না.. কিন্তু অনেকটা প্রাণভরে সবুজ দেয়। ট্রেনে করে যেতে ফসলক্ষেতের সবুজ নয়, গাঢ় চাপা সবুজ। এও কিন্তু আলাদা একপ্রকার বিলাসিতা। খানিক বাদে ফোন এল। (এখানে এই একটি জিনিষ নিয়ে কোনও চাপ ছিল না, যা ছিল তা হল অধিকাংশ সময় কারেন্ট না থাকার ফলে tower থাকলেও phone এ charge ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়।) বলা হল খাওয়ার ঘরের পাহাড়ের দিকের জানলায় এসে দাঁড়াতে এসে দেখলাম সামনের পাহাড়ের এক্কেবারে চূড়োর কাছ থেকে হাত নাড়ছে চেনা রঙের কাপড় পরা কতকগুলি হাত। তাদের সেই জঙ্গল জয়ের একটি video রইল এখানে। এদিকে বাজারের এর কাছে হওয়ার সুবাদে আমাদের অন্য এক আব্দারে সাড়া দিলেন বাড়ির মানুষ।



বাঙালীর মাছ আর মিষ্টি না হলে বোধহয় মানসিক পূর্ণতা আসে না। তাই বাড়ির manager মামাবাবুকে বলে Algarah থেকে আনানো হল মাছ আর রসগোল্লা। আর সীমা বৌদি দুপুরে বানালেন মাছের ঝোল। এই বিলাসীতা ও হয়ত ভাগ্যবানের ই জোটে, যদিও সেই চক্করে ততক্ষনে পেটে ছুঁচোর সমগ্র সৈন্যবাহিনীর পুরো কসরত শেষ। আসলে আমাদের এখানে ‘বাজার কাছে’ আর পাহাড়ে ‘বাজার কাছে’র যে বিস্তর ফারাক তা লোভে পড়ে আমাদের আর মাথায় ছিল না। কিন্তু অপেক্ষার ফল যে শুধু মিষ্টি নয় বড়ই পরিতৃপ্তির হয়, তা এই ক্ষুদ্র, তুচ্ছ মানব জীবনে আবার নতুন করে অনুধাবন করলাম।
ফ্রান্সিস, এই বাড়ির কর্তা কথা দিয়েছিলেন বৃষ্টি না হলে উঠোনে বারবিকিউ এর ব্যবস্থা করবেন। যেমন কথা, তেমনি কাজ! আগুনের চারপাশে বসে হাসি-গান-নাচ-আড্ডা ঝলসানো মুরগীর গন্ধ আর স্বাদ আর দুরে আবার দিওয়ালির আলোয় কালিম্পং… ছোটবেলার একটা বিজ্ঞাপন মনে পড়ে গেল… There are some things money can’t buy! সবই যখন মধুরেন সমাপনের পথে ঠিক তখনই গেল কারেন্ট বন্ধ হয়ে… এও হয়ত যাকে বলে divine intervention! Tour এর শেষ রাতে আমরা এই অসাধারন সুন্দর পরিবেশে candle light dinner করলাম, কোনোও অভিযোগ না করে! (করার লোক বা কারন কোনোটাই যে ছিল তাও নয়। ফ্রান্সিসরা ততক্ষনে ঘুমের দেশে আর কালিম্পংএর এক অংশ ও যে অন্ধকার।



সকালে আমাদের রওনা হওয়ার সময় অবধি তিনি রইলেন মেঘের আড়ালেই। এযাত্রায় আর তার দেখা না পাওয়ার দুঃখ নিয়ে বেরোলাম ফিরতি পথে। কথা হল rafting করে ফিরব। সবাই না গেলেও ১০ জন উৎসাহী কালিঝোরা থেকে Melli Bridge অবধি সেই অদ্ভূত সুন্দর অথচ ভয়ের অভিজ্ঞতার সাক্ষী রইল… প্রায় নাকানি চোবানি খাইয়ে তবে স্রোত কমালো পাহাড়ি তিস্তা… তবে এই অভিজ্ঞতা সবার জীবনে একবার করে অন্তত হলে মন্দ হয় না। দেখতে না দেখতে NJP স্টেশন চলে এল। ফিরতি ট্রেনে অবশ্য এক বড়ই খারাপ অভিজ্ঞতা হল এক যাত্রী পরিবারের দাক্ষিন্যে… শেষে কিনা কামড়ে দিলে!?!?!


সে যাই হোক, যা সঞ্চয় করলাম এই কদিনে, এরকম কিছু তুচ্ছ ঘটনা সেই ব্যাপ্তির কাছে ম্লান। এই সম্পর্কগুলো কি সুন্দর স্বচ্ছন্দ, তাই হয়ত “badi desho mei aisi chhoti baatein” সহজেই ভুলে আবার মেতে ওঠা যায় আড্ডায়… বসে পড়া যায় পরের tour এর প্ল্যান করতে। শেষ বেলায় তাই মনে গুনগুন করা যায়…
Thoda hai thode ki zaroorat hai,
Zindagi firbhi yahaan khoobsoorat hai!