শুনেছিলাম চারখোল থেকে আমাদের পরের গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগবে ঘন্টা দু-এক। আর যাওয়ার রাস্তায় (একটু ঘুরপথে গেলেই) সেই বিখ্যাত Deolo ঘুরে যাওয়া যাবে। তা, এদ্দুর এসেছি যখন বাংলার এমন ঐতিহাসিক স্থান (সেই সারদান্বিত মিটিং এর দৌলতে) একবার ঘুরে যাওয়াই যায়… আর সত্যি শুনেছি জায়গাটি অতি মনোরম। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর পথও যে তার চেয়ে কম মনমুগ্ধকর তা কোনোওমতেই বলা যায় না। পাহাড়ি রাস্তার নাম থাকে বটে, কিন্তু তা আমাদের শহরের মত Google Maps এ তেমন স্পষ্টভাবে লেখা থাকে না আর সত্যি বলতে কি, গাড়ির লাগাম যখন কোনও পারদর্শী স্থানীয় লোকের হাতে থাকে তখন হারিয়ে যাওয়ার ভয় না পেয়ে চারদিকের অদূষিত পরিবেশ উপভোগ করতে করতে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমরাও তাই করতে করতে চললাম। কত পাহাড়ি বাঁক ধরে, শুকনো হয়ে থাকা পাহাড়ি ঝোরার ওপর দিয়ে চললাম আমরা কালিম্পং পাহাড়ের এক পাশ থেকে অন্য পাশে।
প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর বাঙালীর চাতৃষা আর ছবিতৃষা একসাথে নাড়া দিল আমাদের। বেশ সুন্দর একখানি লোহার ব্রীজ পার করে দুই ই পাওয়া গেল – Doodh Koshi Pala Mukti Bridge এ। সুন্দর ছিমছাম পাহাড়ি ঝোরা বা খোলা, হয়ত রঙীতের ই কোনোও শাখানদী। গ্রীষ্মে আপাতত শুকনো… শয়ে শয়ে পাথর ছড়ানো তাতে। কিন্ত এই আপাত শান্ত ঝোরাই হয়ত বেশ কঠোর হয়ে ওঠে বর্ষার হাত ধরে। তার ওপর লোহার পাত ফেলে বেশ শক্তপোক্ত করে তৈরী এই ব্রীজ। গাড়ী গেলে সেই পাতের ওপর কি ভীষন শব্দ – প্রায় ভয় ধরানো। ব্রীজের রেলিং ধরে বাঁধা শয়ে শয়ে রঙবেরঙের বৌদ্ধ প্রণামী পতাকা, যা একভাবে এই জঙ্গল-পাহাড়ের অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ। এখানে তোলা একটি video ছোট্ট দেখতে পারেন এই link টিতে।



বহুদূরে পাহাড়ের কোলঘেঁষা একটা সুন্দর ছিমছাম বাড়িতে চোখটা আটকে গেল। ওখানে যে বা যারা থাকে তাদের বড় হিংসাও হল। কিন্তু ওইটুকুই… এই জীবন আমাদের মত শহুরে মানুষের আয়ত্তের বাইরে। আপাদমস্তক অতি-সামাজিক, অতি-সভ্য প্রযুক্তি-নির্ভরশীল শহুরে অস্তিত্বে হয়ত হাফ ধরবে। আর তারপর ই বিপর্যয়। কারন আমরা মানুষ – আমাদের কাছে প্রকৃতির চেয়ে বেশী দামী আমাদের অহং। তাই তাকে হারতে না দেওয়ার জেদে শুরু হবে এই সুন্দরের বুক চিরে প্রযুক্তি কাছে ডেকে নেওয়ার সফর। তার চেয়ে এই থাক না!
চা ও ছবি বিরতির পর আমাদের ৩টে গাড়ি আবার পাহাড়ের সর্পিল রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল Delo র পথে। Rishi Road নামক রাস্তা ধরে খানিক এগিয়ে আমরা বাঁক নিলাম উপরদিকের একটা রাস্তা ধরে। খানিকটা গিয়ে Guru Rinpoche র মূর্তি ডানদিকে রেখে এগোতেই বাঁদিকের আকাশে একে একে দেখা দিশ বেশ কিছু রঙবেরঙের “অউব” – না এরা মহীনের গানের মত অতটা অজানা নয়, এরা হল paragliders. Delo থেকে paragliding এখন এই পাহাড়ের অন্যতম আকর্ষন… তবে আমার মত ভীতু মানুষের জন্য Google Maps Satellite mode এ দেখলেই এই দুধের স্বাদ দিব্বি ঘোলে মিটে যায়। তবে দূর থেকে দেখতে বেশ লাগে… কেমন বিভিন্ন রঙের বিশাল বিশাল পাখির মত। আমাদের মধ্যে এক অত্যুৎসাহীর বিশেষ আব্দারকে অবশ্য সময়ের কারনে বিরত করা হল। সে যাক…

কালিম্পং শহরটা আদতে একটি উপত্যকা – Delo আর Durpin (Durpin Dara, লেপচা ভাষায় পাহাড়) এর মধ্যবর্তি বেসিন অঞ্চলটিতে রয়েছে উত্তর বঙ্গের দ্বিতীয় জনবহুল বসতি টি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৫৯০ফুট উপরে Delo পাহাড়ের এক্কেবারে চূড়োয় তৈরী হয়েছে Park টি, কালিম্পং বাস স্টেশন থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে। জায়গাটি সুন্দর কিন্তু বড্ড ভীড় – বেশ খানিকটা Lamahatta পার্কের মত। বিভিন্ন প্রকার পাহাড়ি ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো বিশাল বাগান। চারদিকে খাদের ধার বেয়ে নেমে যাওয়া pine গাছের ঘন জঙ্গল। আর যত দূর চোখ যায় শুধু পাহাড়, নদী, জনবসতি… আর তার ই অন্য দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কিন্তু এ সবই ঝকঝকে দিনে। আর আমাদের মাথার ঠিক ওপরটা পরিস্কার আর রোদ ঝকঝকে হলেও, পাহাড়ের এক এক বাঁকে আকাশ এক এক রূপে ধরা দেয়। আর এই পার্কের একেবারে “মধ্যভাগে মজা”-সেই তীর্থস্থান-Delo Tourist Lodge.



যে কোনো পাহাড়ি শহরে সাধারনত এমন একটি জায়গা না থাকলে মাঝেমাঝে ঘুরতে সাধারন মানুষ আর কোথায় যায় বলুন তো? আর প্রেম করতেই বা যায় কোথায়! কিন্তু tourist season এ এই অভিপ্রায় নিয়ে এলে ব্যাপারটা ঠিক জমবে না। এই চত্তরে এসে ওই “I Kalimpong” এর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি না তুলে গেলে যে checkpoint এ একটা
বাকি থেকে যাবে! তাই প্রায় লাইন দিয়ে লোকে অপেক্ষা করে সেই exclusive ছবিটি তোলার জন্য। আমরা বড় গ্রুপ তাই অপেক্ষা ছাড়াই সুযোগ হয়ে গেল।

পার্কে ঢোকার মুখে দোকানের সারি… সেখানে ‘সঅঅঅঅঅব’ ই প্রায় পাওয়া যায়। বেরোবার পথে সেখানে একটু গলা ভিজিয়ে (তার আগে পার্কের গেটের ঠিক বাইরে ফুচকা খেয়ে নিজেদের পাতি বাঙালীত্ব গর্বের সাথে প্রমাণ করে) আমরা চললাম আমাদের পরের দুদিনের আস্তানায় – তন্দ্রাবং।